ই-কর্মাস ব্যবসা শুরু করার গাইড লাইন

প্রিয় পাঠক! কথা বলছি ই-কমার্স ব্যবসা শুরু করার গাইড লাইন নিয়ে। পুরো পৃথিবী ব্যাপী  ই-কমার্স বিজনেস করে অনেকেই আয় করছে লক্ষ লক্ষ টাকা। দিন যতো যাচ্ছে ই-কমার্স ব্যবসার পরিধিও কিন্তু ততোই বিস্তৃত হচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে যে সবাই সফল হচ্ছেন তা কিন্তু নয়। অনেকে সঠিক দিন-নির্দেশনা অভাবে তাদের ই-কমার্স বিজনেসটিকে ঠিকমতো সামনে এগিয়ে নিতে পারছে না। মনে রাখবেন সঠিক নির্দেশনাই পারে আপনাকে সঠিক গন্তব্যে নিয়ে যেতে।



কথা বলছিলাম ই-কমার্স বিজনেস বা ই-বাণিজ্য আসলে কি? দেখুন ইলেকট্রনিক কমার্স বা ই-কমার্স বা ই-বাণিজ্য যাই বলি না কেন এটা হলো এমন একটি বাণিজ্য ক্ষেত্র যেখানে কোনো ইলেকট্রনিক সিস্টেম (ইন্টারনেট বা অন্য কোন কম্পিউটার নেটওইয়ার্ক) এর মাধ্যমে পণ্য বা সেবা ক্রয়/ বিক্রয় করা হয়ে থাকে।

মূলত ই-কর্মাস ব্যবসা শুরু করার একক কোন সূত্র নেই। প্রক্রিয়াটি যতোটা না তাত্ত্বিক তারচেয়ে বেশি বাস্তববাদী। আপনি যদি "কীভাবে একটি -কমার্স ব্যবসা শুরু করবেন" এভাবে লিখে গুগলে সার্চ  করেন তবে এমন অনেক গাইড লাইন বা লেখা খুঁজে পাবেন যা একটি সরল প্রক্রিয়া বর্ণনা করে, যেমন কেমন করে পণ্য বাছাই করবেন, কিভাবে পণ্যের দাম নির্ধারণ করবেন, পণ্য বাজারজাত করবেন কিভাবে, যুৎসই একটি ডোমেন পছন্দ করা, আপনার পণ্যের ব্রান্ডিংয়ের জন্য লোগো তৈরি করা এবং অনলাইন প্ল্যাটফর্ম, সফ্টওয়্যার, বা সরঞ্জাম ইত্যাদি কিভাবে করবনে তার সমস্ত তথ্যই পেয়ে যাবেন।

এই গাইডগুলো যে ভুল আমি তা বলছি না। তবে তার সবগুলো ব্যবহারিক নাও হতে পারে। ধরেন আপনার কোন পণ্য বাছাই করা দরকার। তো আপনি এমন একটি পণ্য বাছাই করলেন যার চাহিদা বর্তমান বাজারে খুবই কম। গ্রাহক নাই বললেই চলে। সেক্ষেত্রে তো আপনি ক্ষতির মুখে পড়বেন।

-কর্মাস ব্যবসা শুরু করার গাইড লাইন নিয়ে আলোচনা করতে চেয়েছিলাম। এবার আসছি মুল প্রসংগে। একটি সফল -কর্মাস ব্যবসা শুরু করার জন্য এই চেকলিস্টগুলোয় একটু চোখ বুলিয়ে নিন।


Ø  সমস্যা সমাধান করা

Ø  মূলধনের ব্যবস্থা

Ø  একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা করা

Ø  পণ্যের উৎস/কোথা থেকে পণ্য সংগ্রহ করবেন

Ø  কাজসমূহের চেকলিস্ট তৈরি করা

Ø  সঠিক পদক্ষেপ নেয়া

 


১) সমস্যা সমাধান করাঃ ই-কমার্স বিজনেস শুরু করার আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন কখনো কোন সমস্যার সঠিক সমাধান বের করতে পেরেছিলেন কিনা? আপনি যে ব্যবসায় বা পরিষেবাটির কথা ভাবছেন তা কি উল্লেখযোগ্য কোন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে কিনা? আপনি কি ভোক্তা বা ক্রেতাদের জন্য এমন কোনও সমস্যা সমাধান করেছেন যা আপনার বিদ্যমান প্রতিযোগিদের চেয়ে ভাল? মনে রাখবেন আপনার -কমার্স ব্যবসার শুরুটা অতোটা তাড়াহুড়া করার দরকার নেই। তবে আপনাকে ধৈর্য্যশীল হতে হবে এবং আপনার গ্রাহকদের জন্য এমন কিছু সরবরাহ করতে হবে যা গ্রাহকদের কোনও সমস্যা সমাধান করতে বা প্রয়োজন মেটাতে সহায়তা করে।

 

২)  মূলধনের ব্যবস্থাঃ এ বিষয়ে একটা কথা বলে রাখি, মূলধন যোগানোর আগে ব্যবসার প্রতি আপনার সদিচ্ছা থাকাটা অনেক জরুরী। আপনার পরিকল্পিত বিবরণের উপর ভিত্তি করে আপনার কি পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন সেটা আগে নির্ধারণ করে নিন। আপনার প্রারম্ভকালীন তথা  ব্যবসার শুরুতে যে ব্যয়গুলো হতে পারে তার একটা তালিকা করে নিন। এইসব ব্যয়ের মধ্যে অন্তর্ভূক্ত থাকতে পারে-

·         অফিসের জন্য উপযুক্ত স্থান

·         সরঞ্জাম সরবরাহ

·         যোগাযোগ ব্যবস্থা

·         উপযোগিতা সমূহ

·         লাইসেন্স এবং অনুমতি

·         কর্মচারীদের বেতন,

·         বিজ্ঞাপন বিপনন,

·         বাজার গবেষণা,

·         ওয়েবসাইট উন্নয়ন.

আরও যোগ হতে পারে-   

  • প্যাকেজিং,
  • রিটার্নস,
  • সফটওয়্যার.

আপনি আপনার ব্যবসা শুরু করার আগে, এর প্রতিটি ব্যয়ের জন্য গবেষণা করুন। এককালীন ব্যয় এবং বারবার খরচের জন্য মাসিক একটা খরচের অংক অনুমান করুন কি পরিমাণ অর্থ লাগতে পারে।

 


৩) সুষ্ঠু পরিকল্পনাঃ আপনি হয়ত একটি ইকমার্স ব্যবসা শুরু করতে চাচ্ছেন, তবে আপনি যদি এটি সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করার এবং পরিকল্পনা করার জন্য সময় না নেন তবে, নির্ঘাত ক্ষতির মুখে পড়ে যাবেন। মজার বিষয় হল, সুষ্ঠু গবেষণা এই ধারণাটিকে সমর্থন করে যে বা যারা ব্যবসায়িক পরিকল্পনা গ্রহন করেন তাদের ব্যবসা চালু করার সম্ভাবনাও কিন্তু অনেক বেশি। আপনি যে পণ্যগুলো বিক্রি করবেন সেগুলোর বর্তমান বাজার সম্পর্কে আপনার ধারনা রাখতে হবে। ই-কমার্স ব্যবসা শুরুর সময় আপনি মনে করবেন যে, আপনি আপনার প্রতিযোগীদের জানেন এবং এর পাশাপাশি কেন আপনি তাদের বিরুদ্ধে সফল হতে পারেন সেই বিষয়েও জানার চেষ্টা করুন। সুষ্ঠু ব্যবসায়িক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে কিছু বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করা উচিৎ। যেমন-

 

) আপনার কোম্পানীর বিবরণঃ কোম্পানীই বলি আর অনলাইন বিজনেস বা শপ যাই বলি না কেন তার একটা বিশদ বিবরণ আপনার নিকট থাকা উচিৎ। ব্যবসাটি কিভাবে পরিচালনা করবেন, পণ্য কি হবে, কোথা থেকে পণ্য সংগ্রহ করবেন, মার্কেটিং পলিসি কি হবে, অর্থের যোগান হবে কিভাবে, কীভাবে এটি অর্থ উপার্জন করবে এবং ব্যবসাটি প্রতিযোগিতা মূলক কিনা, অন্যদের থেকে কতোটা পৃথক করে তা সংক্ষিপ্ত করে হলেও তার বিবরণী যোগ করে নেওয়াটা ভালো।

 

) বাজার বিশ্লেষণঃ ব্যবসা করার ক্ষেত্রে যেসব সমস্যার সমাধান হবে তার একটা বিবরণ দিন পাশাপাশি এটা আপনার কি কি প্রয়োজন পূর্ণ করবে তার একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনাও দিন। আপনার কোম্পানির/অনলাইন শপ গ্রাহকদের কিভাবে সেবা দিবে, কীভাবে তাদের আস্থা অর্জন করবে এবং পণ্য পরিবেশন করবে তা বর্ণনাও যোগ করুন।

 

) আর্থিক বিষয়াদীঃ অনুমিত আয়ের বিবৃতি, ব্যালেন্স শীট এবং নগদ প্রবাহের বিবরণ এখানে অন্তর্ভুক্ত করুন। আপনি যদি হিসাব-নিকাশ সম্পর্কে কম জানেন তবে একজন অ্যাকাউন্টেন্ট নিয়োগ করতে পারেন।

 

) ব্যবসায়ের মডেলঃ -কমার্স বিজনেস মডেল রয়েছে মোট ছয়টি যার মধ্যে চারটি আপনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে: () ব্যবসায়ী টু গ্রাহক (যার মধ্যে প্রত্যক্ষ গ্রাহকও অন্তর্ভুক্ত থাকে), () ব্যবসা টু ব্যবসা, () ব্যবসায়ী টু সরকার, () গ্রাহক থেকে গ্রাহক ( বিষয়গুলো নিয়ে একটি ভিডিওতে অন্য কোন একদিন বিশদ আলোচনা করবো)

 

) বিক্রয় মাধ্যমগুলোর বর্ণনাঃ আপনার পণ্য আপনি কোথায় বিক্রি করতে চান? প্রথমেই অনলাইনে বিক্রি করবেন নাকি অন্য কোথাও? পরে কি কোনও ওয়েবসাইট যুক্ত করবেন? আপনি কি দারাজ, বিক্রয় ডট কম বা অন্যকোন অনলাইন মার্কেটপ্লেসের মাধ্যমে বিক্রি করবেন? প্রতিটি চ্যানেল কীভাবে কাজ করে, এর সুবিধা-অসুবিধা এবং কীভাবে আপনার ব্যবসায় প্রতিযোগিতা করতে পারে তা বুঝতে সময় নিন, চিন্তা করুন।

 

) বিপণন পরিকল্পনাঃ বাংলায় একটা কথা আছে প্রচারে প্রসার। আপনার ব্যবসা কীভাবে গ্রাহকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে সে সম্পর্কে আপনার স্পষ্ট ধারণা থাকা উচিত। আপনি কিসের মাধ্যমে আপনার ব্যবসাটিকে প্রচার করবেন? লিফলেট বিতরণ করতে পারেন, পত্রিকায়/টিভিতে বিজ্ঞাপন দিতে পারেন, আপনার স্থানীয় এলাকায় প্রচারের জন্য মাইকিং করতে পারেন? স্যোশাল মিডিয়ায় আসতে পারেন। এককথায় আপনার ব্যবসাটিকে সবাইকে জানাতে হবে। প্রথমদিকে হয়তো সাফল্য নাও আসতে পারে তবে হতাশ হবেন না। একটি সুন্দর ব্যবসায়িক পরিকল্পনা তৈরি করুন, কাজে লাগবে।

 


৪) পণ্যের উৎস/কোথা থেকে পণ্য সংগ্রহ করবেনঃ পণ্য সংগ্রহ করা খুব কঠিন কিছু কি? হতে পারে তাদের জন্য যারা পণ্যের উৎস সম্পর্কে ওয়াকিবহাল না। নতুন উদ্যোক্তাদের দেখতে হবে সফল খুচরা ব্যবসায়ী বা সফল উদ্যোক্তাগণ বছরের পর বছর ধরে কী করেছে তার দিকে মনোনিবেশ করতে হবে। সরবরাহ চেইনের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করুন। এটি কয়েকটি ধাপে বা ফর্মে হতে পারে। যেমন-

 

) সরাসরি ব্র্যান্ডের পণ্য কেনাঃ ধরুন আপনি যদি নাইকের জুতো এবং পোশাক বিক্রি করতে চান তাহলে কি করতে হবে? আপনি যে কোম্পানীর পণ্য বিক্রি করবেন সরাসরি তার কাছ থেকে কিনতে হবে। আপনি যদি সনির কোন পণ্য বিক্রি করতে চান তবে আপনাকে সরাসরি সনি থেকে কিনতে হবে। যদিও এরা ন্যূনতম অর্ডার নেয় তবে এটিও সম্ভব। এটি উদাহরণ হিসেবে দিলাম। অর্থাৎ আপনি যে পণ্য নিয়ে ব্যবসা করবেন আপনার চেষ্টা থাকবে সরাসরি সেই পণ্যগুলো কোম্পানীর কাছ থেকে কেনা। 

) ডিসট্রিবিউরদের কাছ থেকে কেনাঃ ডিসট্রিবিউরদের কাছ থেকেও পণ্য কিনতে পারেন। সারাদেশে এমন অনেক পরিবেশক আছে যারা নাম করা কোম্পানীল পণ্য বিক্রি করে থাকে। তাদের কাছ থেকে পণ্য কিনেও ব্যবসা করতে পারেন।

 

) নিজেই পণ্য তৈরি করে বিক্রি করাঃ আপনি যদি হস্তনির্মিত আসবাবপত্র, গয়না, খাবার ইত্যাদি বিক্রি করতে চান তবে আপনি নিজের ওয়ার্কশপে/বাসায় নিজের তালিকা অনুযায়ী তৈরি করতে পারেন। এছাড়াও সফ্টওয়্যার, ওয়েবসাইট, ইবুকস এবং অনুরূপ ডিজিটাল পণ্য সহ আপনি নিজে তৈরি করতে পারেন এমন অনেকগুলো পণ্য আছে যেগুলো বানিয়ে বিক্রি করতে পারেন।

 

) কোম্পানীর কাছ থেকে পণ্য কেনাঃ আপনি সরাসরি যেকোনও কোম্পানীর নিকট থেকেও পণ্য ক্রয় করতে পারেন।এটা সরাসরি গ্রাহক টু বিক্রেতাদের মধ্যে একটা প্রিয় মাধ্যম। এমন অনেক কোম্পানী আছে যারা আপনার ব্যবসার জন্য আপনার চাহিদা মতো পণ্য তৈরি করে সরবরাহ করবে। তাহলে আপনি দ্রুতই লাভের মুখ দেখতে পারবেন।

 

৫) কাজসমূহের চেকলিস্ট তৈরি করাঃ এই আলোচনাটি এখন শেষের পথে এবং আপনি যেহেতু মনোযোগ সহকারে পড়েছেন তাই আমি ধরে নিতে পারি  উদ্যোক্তা হওয়ার পথে আপনি অনেকটাই এগিয়ে গেছেন। এখন আপনি যে কাজগুলো করবেন তার একটা চেকলিস্ট তৈরি করে নিবেন। এখন যা করতে হবে তা হলো আপনাকে বাজার গবেষণা করতে হবে। কেননা বাজারের নির্দিষ্ট জাগয়াটি বুঝতে পারা আপনার জন্য অপরিহার্য। এক্ষেত্রে যে  বিষয়গুলো বিবেচনায় নিতে পারেন তা হলোঃ-

 

) চাহিদা অনুমান করাঃ কোন ধরনের লোকেরা আপনার পণ্য কিনবে কিংবা কোন ধরণের পণ্যের চাহিদা আছে সেটা আপনাকে অনুমান করতে হবে। গ্রাহকের চাহিদা অনুয়ায়ী যদি পণ্য সরবরাহ করতে না পারেন তবে আপনার ব্যবসা কিন্তু টিকবে না।

 


) সময়ঃ উদ্যোক্তাদের জন্য সময় একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আপনার ব্যবসা শুরু করার এখন কি সেরা সময়? আপনার সম্ভাব্য গ্রাহকরা কি মন্দার মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন? তারা কি তাদের কেনার অভ্যাস বদলেছে? এই প্রশ্নগুলো আগে নিজেকে করতে হবে।

 

) দামঃ আপনি কি লাভজনক দামের মধ্যে আপনার পণ্য বা পরিষেবা বিক্রি করতে পারেন? কেন অথবা কেন নয়? এগুলোর উত্তর জানাটাও জরুরী।

 

ঘ) আপনার নিজস্ব একটা ব্র্যান্ড তৈরি করুনঃ আপনার কোম্পানি, পণ্য বা সেবাকে ব্র্যান্ড হিসেবে তৈরি করতে হলে প্রথমেই ভাবতে হবে এর ক্রেতা হবেন কারা। একটি ব্র্যান্ড কয়েকটি উপাদানের সমন্বয়। হতে পারে-

Ø  কোম্পানীর একটা সুন্দর লোগো

Ø  কোম্পানীর ভিশন মিশন

Ø  কাস্টমার সার্ভিস

Ø  প্যাকেজিং ইত্যাদি

 

৬) সঠিক পদক্ষেপ নেয়াঃ আপনি একটি -কমার্স ব্যবসা শুরু করার জন্য এই ব্যবহারিক গাইডের শেষে পৌঁছে গেছেন। এখন আপনার প্রয়োজন উদ্যোক্তা হওয়া,  নতুন জিনিস শেখার আগ্রহ এবং যা শিখেন তা বাস্তবে রূপ দিতে পারবেন। এখনই পদক্ষেপ নেওয়ার উপযুক্ত সময়। আপনার জীবনকে পরিবর্তন করতে পারে এমন ব্যবসা আজই শুরু করুন।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন